নতুন কিংবা পুরাতন কোম্পানি সংগঠনের মূলধন সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার হলো শেয়ার। ইংরেজি ‘Share’” শব্দের আভিধানিক অর্থ 'অংশ' । কোম্পানি সংগঠনের ক্ষেত্রে শেয়ার-এর অর্থ হচ্ছে-কোম্পানির মোট মূলধনের অংশ। কোম্পানির মোট মূলধনকে মোট সমপরিমাণ কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে বিভক্ত করা হয়। এদের প্রত্যেকটি একককে এক একটি শেয়ার বলে। প্রত্যেকটি শেয়ারের নির্দিষ্ট আংকিক মূল্য (Face value) থাকে এবং প্রত্যেকটির মূল্য সমান থাকে। যেমন-কোনো কোম্পানির ১০ লক্ষ টাকার মূলধনকে ১০,০০০ ভাগে ভাগ করা হলে এক একটি ভাগের মূল্য হবে ১০০ টাকা। মূলধনের এ শেয়ারের মালিক হয়ে কোম্পানির মালিকানা দাবি করা যায়। কোম্পানির নির্বাচনে ভোটদানের অধিকার পাওয়া যায়। বৃহদায়তন কোম্পানি চলমান অবস্থায় আর্থিক সংকটে পড়লে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে।
সুতরাং কোম্পানির সমগ্র মূলধনকে সমপরিমাণ এককে বিভক্ত করলে প্রত্যেকটি একককে শেয়ার বলে। প্রত্যেকটি এককই সমান মূল্য বহন করে এবং মূলধনের একটি ক্ষুদ্র অংশ নির্দেশ করে, যাকে শেয়ার বলে । পরিশেষে বলা যায় যে, শেয়ার হচ্ছে কোম্পানির মোট মূলধনের অংশ। যে ব্যক্তি শেয়ার ক্রয় করে তাকে শেয়ারহোল্ডার বলে । প্রত্যেকটি শেয়ার মূলধনের অংশ বলে সেটি ক্রয়ের দ্বারা শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির আংশিক মালিকানা লাভ করে এবং এর বলে তারা কোম্পানির লভ্যাংশ পাবার অধিকার লাভ করে। কোম্পানির বিলোপ সাধন ঘটলে শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির সম্পত্তিতে প্রদত্ত মূলধনের আনুপাতিক অংশ ফেরত পাবার অধিকারী হয়।
শেয়ার হলো যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনের ক্ষুদ্রতম অংশ। কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করার জন্য জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। কোম্পানি নিজের এবং বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করে,বিভিন্ন প্রকার শেয়ার ইস্যু করে।
নিম্নে ছকের মাধ্যমে শেয়ারের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো—
যে শেয়ারের মালিকগণ অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ারের মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের পর লভ্যাংশ পায় এবং ব্যবসায় বিলোপ সাধনকালেও অগ্রাধিকার যুক্ত শেয়ার মালিকদের মূলধন দেয়ার পর তাদের মূলধন ফেরত পাবার অধিকারী হয় তাকে সাধারণ বা ইক্যুইটি শেয়ার বলে ।সাধারণ শেয়ারের লভ্যাংশের হারের কোনো স্থিরতা নেই। লাভ বেশি হলে লভ্যাংশ বেশি হবে আর লাভ কম হলে তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশও কম হবে। সাধারণ শেয়ারকে ইক্যুইটি শেয়ার বলা হয়। এ ধরনের শেয়ার মালিকগণ পূর্ণ ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন এবং ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ।
যে শেয়ারের মালিকগণ ব্যবসায়ের লভ্যাংশ বণ্টনের ক্ষেত্রে বা ব্যবসায়ের বিলোপ সাধনের সময়ে তাদের মূলধনের অর্থ ফেরত পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারলাভ করে থাকেন তাকেই বলে অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ার । কোম্পানি আইনের ৮৫ নং ধারায় বলা আছে যে, অগ্রাধিকার শেয়ার হলো কোম্পানির শেয়ার মূলধনের সেই অংশ যা নিরূপ সুবিধাসমূহ ভোগ করে থাকে :
(ক) লভ্যাংশ বণ্টনের সময় এ শেয়ারের নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পাবার অগ্রাধিকার থাকে।
(খ) কোম্পানি বিলোপ হলে মূলধন ফেরত দেবার অগ্রাধিকার থাকতে পারে ।
লভ্যাংশ বণ্টন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার শেয়ারকে আবার কতিপয় শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—
i. সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Cumulative Preference Share): যদি কোনো বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত না হয় তাহলে কোম্পানি তাদের লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হয় । তবে তাদের অপরিশোধিত লভ্যাংশ বকেয়া রেখে পরে যখন কোম্পানি মুনাফা অর্জিত হয় তখন বর্তমান লভ্যাংশের সাথে পূর্বের অপরিশোধিত বকেয়া লভ্যাংশ পরিশোধ করে দেয়া হয়। অপরিশোধিত লভ্যাংশ কোম্পানির কাছ পাওনা হতে থাকে এবং মুনাফা অর্জিত হলে কোম্পানি তা প্রদান করে। এ ধরনের শেয়ারকে সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার বলা হয়ে থাকে ।
ii. অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Cumulative Preference Share): এ শ্রেণীর শেয়ার মালিকগণ কেবলমাত্র যে বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত হয় সে বছরই লভ্যাংশ পাবার অধিকারী হয়। যদি কোনো বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত না হয় তাহলে তারা কোম্পানির কাছে ঐ বছরের মুনাফা দাবি করতে পারে না এবং এরূপ মুনাফা কোম্পানির কাছে তাদের পাওনা হয় না। এ কারণে এরূপ শেয়ারকে অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার বলে ।
iii. পরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Redeemable Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে শেয়ার মালিকদের ফেরত দেয়া হয় তাকে পরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে। এরূপ শেয়ার কেবল পরিমেল নিয়মাবলির অনুমোদনক্রমে কোম্পানি আইনের শর্ত অনুযায়ী বিক্রয় করা চলে। এটি মূলত শেয়ার ও ঋণপত্রের মিশ্রিত এক বিশেষ ধরনের শেয়ার।
iv. অপরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Irredeemable Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য কোম্পানির বিলোপ সাধনের পূর্বে ফেরৎ পাওয়া যায় না তাকে অপরিশোধ্য শেয়ার বলে ।
v. অংশগ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার (Participating Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মালিকগণ মুনাফা হতে প্রথমত নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীতে সাধারণ শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের সময় পুনরায় তার অংশ পায় তাকে অংশগ্রহনকারী অগ্রাধিকার শেয়ার বা পার্টিসিপেটিং শেয়ার বলে ।
vi. অংশ না গ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Participating Preference Share): যে জাতীয় শেয়ারের মলিকগণ মুনাফা হতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পায় কিন্তু সাধারণ শেয়ার মালিকদের মাধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের সময় পুনরায় অংশ পায় না তাকে অংশ না গ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার বা নন পার্টিসিপেটিং শেয়ার বলে ।
vii. পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Convertible Preference Share ) : শেয়ার বিক্রয়ের শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ান্তে যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ দেয়া হয় তাকে পরিবর্তনযোগ্য শেয়ার বলে ।
viii. অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Convertible Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে কখনই সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরিত করা যায় না তাকে অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে ।
অগ্রাধিকার শেয়ার ও সাধারণ শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের পর এ শ্রেণীর শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টন করা হয়। আবার কোম্পানির বিলোপ সাধনের ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত দুই শ্রেণীর শেয়ার মালিকদের মূলধনের অর্থ প্রত্যার্পণ করার পর যদি মূলধনের বা সম্পত্তির কোনো উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে তাদের দাবি মেটানো হয়। কাজেই কোম্পানির লভ্যাংশ বণ্টন বা মূলধন প্রত্যর্পণের বিষয়ে এরা সর্বশেষ দাবিদার বা অধিকারভোগী। কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তারাই এ শ্রেণীর শেয়ারের মালিক হয়। এ ধরনের শেয়ারকে প্রবর্তকের শেয়ার বা Founder's Share বলে।
সাধারণভাবে উপরে বর্ণিত তিন ধরনের শেয়ার দেখা যায়। তবে অনেক সময় কোম্পানিকে উপরের শেয়ারগুলো ছাড়াও বিভিন্ন নামে শেয়ার বণ্টন করতে দেখা যায়। বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিতে এ শেয়ারগুলো সাধারণ শেয়ার ।
নিম্নে তিন ধরনের বিশেষ শেয়ারের বর্ণনা দেয়া হলো—
ক. অধিবৃত্তি/বোনাস শেয়ার (Bonus Share): কখনও কখনও কোম্পানি অর্জিত মুনাফার কিছু কিছু অংশ সদস্যদের মধ্যে বণ্টন না করে কোম্পানির উন্নয়নের জন্য সংরক্ষিত তহবিলে তা জমা রাখে । তহবিলে রক্ষিত এই অবণ্টিত মুনাফা থেকে সৃষ্ট লভ্যাংশ পরবর্তীতে শেয়ার মালিকগণকে নগদে প্রদান না করে ঐ লভ্যাংশের বদলে কোম্পানি শেয়ার ইস্যু করে। নগদ লভ্যাংশের বদলে যে শেয়ার ইস্যু বা প্রদান করা হয় সেই শেয়ারকে অধিবৃত্তি বা বোনাস শেয়ার বলে। এ শেয়ারকে বিশেষ ধরনের শেয়ার বলা হলেও এ শেয়ার সাধারণ শেয়ারের অন্তর্গত। বোনাস শেয়ারের আংকিক মূল্য নগদে শেয়ার মালিকগণকে না দিয়ে তা সংরক্ষিত তহবিল থেকে মূলধন তহবিলে রূপান্তর করা হয়।
খ. অধিকার বা রাইট শেয়ার (Right Share): প্রয়োজনের তাগিদে অধিকতর মূলধন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোম্পানি আবার নতুন করে শেয়ার বাজারে ছাড়ার সময় বর্তমান শেয়ার মালিকদেরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বর্তমান (existing) শেয়ার মালিকগণ তাদের অধিকারভুক্ত পূর্বে ক্রীত শেয়ারের অনুপাতে নতুন শেয়ার ক্রয়ের অধিকারী হয়। অধিকার প্রাপ্ত এ নতুন শেয়ারকে রাইট শেয়ার বলে। মনে করা যাক, কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা ২:১ অনুপাতে রাইট শেয়ার ইস্যু করবে। অর্থাৎ যার পুরাতন ২টি শেয়ার আছে সে ১টি নতুন শেয়ার ক্রয়ের রাইট শেয়ার হিসেবে পাবে। রাইট শেয়ারও কোনো পৃথক ধরনের শেয়ার নয় । এটি সাধারণ বা অগ্রাধিকার শেয়ার হতে পারে।
গ. অনির্ধারিত মূল্য বা অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার (No-par value Shares): যে শেয়ারের কোনো আঙ্কিক মূল্য পূর্ব হতে নির্দিষ্ট থাকে না, বছর শেষে হিসাব-নিকাশের পর মোট সম্পদ হতে মোট অন্যান্য দায়ের পরিমাণ বাদ দিয়ে শেয়ারের মূল্যমান নিরূপণ করা হয়, তাকে অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার বলে। আমাদের দেশে এ ধরনের শেয়ারের প্রচলন নেই। আমেরিকায় এ ধরনের শেয়ার বেশি দেখা যায়। প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগণ এ শেয়ারের মালিক হয় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের শেয়ারের ব্যবহার ঘটায় শেয়ারহোল্ডারগণ তাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী এসব শেয়ার ধারণ করেন। উপরের আলোচনায় বিভিন্ন ধরনের শেয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ।
Read more